“সন্ন্যাসী তাহার ঝুলি হইতে আহুত সমস্ত তণ্ডুল নিজের হাতে বনের পশু-পক্ষীকে বিলাইয়া দিলেন।” তীর্থক্ষেত্রে রাজা স্বহস্তে ভাণ্ডার হইতে দরিদ্রকে ধন দিতেছেন।”
প্রথম বাক্যটিতে ‘সন্যাসী’ কর্তা, এবং “বিলাইয়া দিলেন’ ক্রিয়াপদ। অন্যান্য পদগুলিও ক্রিয়ার সহিত অন্বিত।
কে বিলাইয়া দিলেন? – সন্ন্যাসী (কর্তৃ সম্বন্ধ)
কি বিলাইয়া দিলেন? – তণ্ডুল (কর্ম সম্বন্ধ)
কিসে বিলাইয়া দিলেন? – হাতে (করণ সম্বন্ধ)
কাহাকে বিলাইয়া দিলেন? – পশু-পক্ষীকে (সম্প্রদান সম্বন্ধ)
কোথা হইতে বিলাইয়া দিলেন? – ঝুলি হইতে (অপাদান সম্বন্ধ)
কোথায় বিলাইয়া দিলেন? -বনে (অধিকরণ সম্বন্ধ)
দ্বিতীয় বাক্যটিও অনুরূপভাবে বিশ্লেষণ করা যাইতে পারে।
বাক্য মধ্যে ক্রিয়া পদের সহিত বিশেষ্য (ও সর্বনাম) শব্দগুলির যে অন্বয় (অর্থাৎ পরস্পর সম্পর্ক) তাহাকে বলে কারক (ক্রিয়াম্বয়ি কারকম) বিভক্তি হইল কারকসূচক ধ্বনি সমষ্টি বা পদাংশ সৈংখ্যাকারক-বোধয়িত্রী বিভক্তিঃ)।
বিভক্তি দুই প্রকার –
১। যথার্থ বা সুব্ বিভক্তি : যথা কে, রে, এ, তে প্রভৃতি।
২।কর্মপ্রবচনীয় পরাসর্গ বা অনুসর্গ : দ্বারা, দিয়া, করিয়া, কর্তৃক ইত্যাদি । বাংলায় কোন কারকেরই একেবারে নিজস্ব বিভক্তি নাই। একই বিভক্তি বিভিন্ন কারক বুঝায়।
বাংলায় কারক ছয় প্রকার :- কর্তা, কর্ম, করণ, সম্প্রদান, অপমান এবং অধিকরণ।
(ক) প্রযোজক কর্তা : সাপুড়ে সাপ খেলায়।
(খ) সমধাতুজ কর্তা : মন্দিরে আরতির বাজনা বাজিতেছে।
(গ) নিরপেক্ষ কর্তা : গোলাগুলি ছুটিলে শত্রুরা পলায়ন করিল।
(ঘ) ব্যতিহার কর্তা : মায়ে পোয়ে রওনা দিয়েছে।
(৬) অনুজ্ঞা কর্তা : ছবিখানি এখনও দেখা হয় নাই।
কর্তার শূন্য’ এ, তে, র, কে ইত্যাদি বিভক্তির প্রয়োগ হয়।
কর্মকারক : যাহাকে আশ্রয় করিয়া ক্রিয়ার কর্ম সম্পাদিত হয় তাহাই কর্মকারক। যেমন- “শ্যাম ‘চিঠি’ পাইয়াছে। রাম ‘শ্যামকে’ মারিয়াছে।
(ক) গৌণ কর্ম ও মুখ্য কর্মের দৃষ্টান্ত : শিক্ষককে ছাত্রকে প্রশ্ন করিতেছেন। এখানে “ছাত্র’ গৌণ কর্ম ও ‘প্রশ্ন’ মুখ্য কর্ম।
(খ) প্রযোজক ক্রিয়ার কর্ম : গৃহ শিক্ষক ছাত্রকে প্রতিদিনই অঙ্ক করাইয়া থাকেন।
(গ) উদ্দেশ্য কর্ম : দুর্জনে কুবুদ্ধি দিয়া ভাল লোককে মন্দ করিতে পারে।
(ঘ) বিধেয় কর্মের দৃষ্টান্ত : ‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে নামানো মণি।
(ঙ) সমধাতুজ কর্ম : মরণের ‘ভাবনা’ আমি ভাবিনা।
(চ) দুইটি ক্রিয়ার একটি কর্মের দৃষ্টান্ত : ‘কাপড়টি’ কিনিয়া আনিবে। কর্মকারকে ‘শূন্য’ ‘কে’, ‘রে’, ‘এ’ বিভক্তি প্রয়োগ হয়।
করণ কারক : যাহার সাহায্যে কর্তা ক্রিয়া সম্পাদন করে তাহাই করণ কারক। ‘বাতাসে’ লঘু মেঘ উড়িয়া যায়।
(ক) সাধন বা যন্ত্রাত্নকক করণের দৃষ্টান্ত : চতুর ব্যক্তি ‘কাটা দিয়া’ কাঁটা তুলিতে পারে।
(খ) উপায়াত্মক করণের দৃষ্টান্ত : ‘সময়ে’ মানুষ সবই ভুলিয়া যায়।
(গ) হেতুময় করণ : বড় ‘দুঃখে, আজ
আমি এখানে আসিয়াছি।
(ঘ) কালাত্মক করণ : চার ‘দিনে’ আমি কাজটি সারিয়া ফেলিলাম।
(ঙ) লক্ষণাত্মক করণ : ‘ধর্মপরায়ণতায়’ যুধিষ্ঠির, ‘শক্তিমত্তায়’ ভীম এবং ‘বীর্যমতায়” অর্জুন ।
(চ) একাধিক করণের দৃষ্টান্ত : তিনি একমনে ‘কলম দিয়া’ লিখিতেছেন।
করণ কারকে এ, য়, তে, র, এর, শূন্য, দ্বারা দিয়া ইত্যাদি বিভক্তির প্রয়োগ
সম্প্রদান কারক : স্বত্বত্যাগ করিয়া যাহাকে কিছু দান করা যায় অথবা যাহার নিমিত্তে বা যাহার উদ্দেশ্যে কিছু করা যায়, তাহাই সম্প্রদান কারক। যেমন- পিতা ‘সংপাত্রে’ কন্যাদান করিলেন। এখন ‘ঘরকে’ (ঘরের উদ্দেশ্যে) যাও ৷ ‘জলকে’ (জলের নিমিত্তে) চল।
অপাদান কারক : কোনও কিছুর অপায় বা বিশ্লেষ বুঝাইলে অপাদান কারক হয়। এক বস্তু হইতে অপর বস্তুর বিচ্ছিন্নতাকে ‘অপায়’ বলে। যাহা হইতে কোন বস্তু বা ব্যক্তির চলন, পতন, উত্থান, গ্রহণ, নির্গম ইত্যাদি সংঘটিত হয় তাহাকে অপাদান কারক বলে। যথা- সে’ গেলাস হইতে’ জল খাইল। “তিনদিন হইতে” আমার জ্বর হইয়াছে!
অপাদানের প্রকার ভেদ :
(ক) আধার বা স্থানবাচক : ছেলেটি ‘ছাদ’ হইতে পড়িয়া গেল।
(খ) অবস্থাত্মক অপাদান : চলন্ত ট্রেনের ‘কামরা হইতে’ তিনি কথা বলিতে লাগিলেন।
(গ) কালবাচক অপাদান : আমাদের ‘গৃহ হইতে’ আজানের ধ্বনি শোনা যায়।
(ঘ) দূরত্ববাচক অপাদান ? ‘কলিকতা হইতে দ্বারভাঙ্গা তিনশত মাইলেরও অধিক দূরে অবস্থিত।
(ঙ) তারতম্যবাচক অপাদান : মিনুর চেয়ে গোপার বয়স বেশি।
অধিকরণ কারক : যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ক্রিয়াৰ আধার কাল বা ভাব বুঝায়, তাহাই অধিকরণ কারক। যথা – আগামী ‘বৎসরে’ দুর্ভিক্ষ হইবে।
অধিকরণ কারক তিন প্রকার – আধারাধিকরণ, কালাধিকরণ ও ভাবাধিকরণ।
(ক) আধারাধিকরণ : ক্রিয়ার আধার মাত্রেই অধিকরণ। এই অর্থে যে কোন অধিকরণই
আধারাধিকরণ। তৎসঙ্গেও বৈয়াকরণগণ আধারাধিকরণ নামক পৃথক ভাগ করিয়া ইহার কয়েকটি উপ-বিভাগ করিয়াছেন – একদেশিক, বৈষয়িক, অভিব্যাপক, সামীপিক।
(১) একদেশিক: আধারের এক অংশে অবস্থিত, এই অর্থে একদেশিক অধিকরণ হয়। যথা – নদীতে মাছ আছে।
(২) বৈষয়িক : “কোন একটি বিষয়ে” এই ভাবটি যখন প্রকাশ পায় তখন বৈষয়িক অধিকরণ বলে। যথা, তিনি সঙ্গীত শাস্ত্রে কৃতবিদ্যা ব্যক্তি ।
(৩) অভিব্যাপক : সমগ্র অংশ ব্যাপ্ত করিয়া থাকিবার ভাব বুঝাইলে অভিব্যাপক অধিকরণ বলে। যথা, তিলে তৈল ও দুধে মাখন আছে।
(৪) সামীপিক : সামীপ্য বুঝাইতে ৷ যথা রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়াইয়া শোভাযাত্রা দেখিতেছে।
(খ) ভাবাধিকরণ : যে অধিকরণ কারকে ভাবের বিষয় প্রকাশিত হয় তাহাকে ভাবাধিকরণ বলে। যথা-
আমি শোক সাগরে নিমগ্ন হইলাম।
তিনি আনন্দ সাগরে ভাসিতে লাগিলেন।
(গ) কালাধিকরণ : কালের ক্ষণিকত্ব বা ব্যাপ্তি বুঝাইতে কালাধিকরণ হয়।
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি।
শীতে গরীবের বড় কষ্ট হয়।
সম্বন্ধ পদ : যে পদের অন্য পদের (বিশেষ্য বা সর্বনাম) সহিত সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকে, কিন্ত
ক্রিয়ার সহিত উহার অন্বয় থাকে না তাহাকে সম্বন্ধ পদ বলে। ক্রিয়ার সহিত ইহার অন্বয় নাই, তাই ইহা কারক নহে। সম্বন্ধ পদে ‘র’, ‘এর’, ‘কার’, বিভক্তির প্রয়োগ হয়। সম্বন্ধ নানা প্রকারের যথা-
(ক) কর্তা সম্বন্ধ – শিশুর খেলা; নদীর প্রবাহ
(খ) কর্ম সম্বন্ধ – ঈশ্বরের উপাসনা, চাদের দেখা।
(গ) করণ সম্বন্ধ – কলমের লেখা।
(ঘ) অপাদান সম্বন্ধ – ভুতের ভয়।
(ঙ)অধিকরণ সম্বন্ধ – জলের মাছ, বনের পশু।
(র) অভেদ সম্বন্ধ – বিদ্যার সাগর।
(ছ) কার্য-কারণ সম্বন্ধ – পাপের শাস্তি।
(জ) যোগ্যতা সম্বন্ধ – খাইবার ঔষধ।
(ঝ) গতি সম্বন্ধ – কলের জাহাজ।
(ঞ) বিশেষণ সম্বন্ধ – সুখের সংসার।
(ট) ব্যাপ্তি সম্বন্ধ – পাঁচদিনের পথ।
(ঠ) তারতমা সম্বন্ধ – সে শ্যামের চেয়ে বড়।
(ড) অব্যয় যোগে সম্বন্ধ – জোরের সঙ্গে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
(ঢ) বাক্য বিবক্ষায় – হরেন যে বিশেষ দুঃখিত তাহার (তাহাতে আর কোন সন্দেহ
নাই।)
(ণ) ‘কার’ বিভক্তি প্রয়োগ সম্বন্ধ – পরশুকার, সেখানকার।
সম্বোধন পদ : যাহাকে আহ্বান করা যায় তাহাকে বলে সম্বোধন পদ। ক্রিয়া পদের সহিত সম্বন্ধ থাকে না বলিয়া সম্বোধন পদ ও সম্বন্ধে ন্যায় কারক নহে। সংস্কৃতে সম্বোধনে যে রূপ বাক্যের রূপান্তর হয়, খাঁটি বাংলায় সেরূপ হয় না। তবে সে সকল তৎসম শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয় উহারা সংস্কৃতের ন্যায় পরিবর্তন সহ।
১। তৎসম শব্দের সম্বোধনের দৃষ্টান্ত –
(ক) শুন, শুন, ওহে মিত্র, পরম বান্ধব।
(খ) রে প্রমত্ত মন মম, কবে পোহাইরে রাতি।
(গ) হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ, ঝলিছে, অমল শোভাতে।
২। কখনো কখনো সম্বোধনসূচক অব্যয়ের প্রয়োগ হয়। যথা, ওগো, শুনেছ?
৩। খাঁটি বাংলায় সম্বোধন পদের কোন পরিবর্তন হয় না। যথা, ওহে বন্ধু! হে মুনি!
৪। সম্বোধন পদের বহুবচনে ‘রা কিংবা ‘গুলা’ ‘গণ’ ‘সমূহ’ প্রভৃতি প্রযুক্ত হয়। যথা, ওগো মেয়েরা, হে বন্ধুগণ; প্রভৃতি।
আরোও পড়ুন–