অমলপ্রভা দাসের জীবনী
অমলপ্রভা দাসের জীবনী |
অমলপ্রভা দাসের জীবন-যাপন :
অসমের এক সংস্কৃতি সম্পন্ন আদর্শবান পরিবারে অমলপ্রভা দাসের জন্ম। অর্থনৈতিক ভাবে অবস্থাপন্ন হলেও তার পিতা-মাতা অনাড়ম্বর সরল জীবন-যাপন করতেন। তাদের পরিবারে দেশপ্রেম এবং সমাজ সেবার এক পরিবেশ বিরাজিত ছিল। ছোটোবেলা থেকেই অমলপ্রভা সেই পরিবেশেই বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। পড়াশোনার প্রতি তার ছিল অদম্য আগ্রহ । তিনি অত্যন্ত মেধাবীও
ছিলেন। তবে তিনি অনবরত বই-পত্র নিয়ে পড়াশোনাতেই ব্যস্ত হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন না। বিদ্যালয়ের ছুটির পর বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে সংসারের কাজ-কর্মে সাহায্য কর৷ দেওয়া ইত্যাদি কাজ খুব আনন্দে করতেন। নাচ-গান বাগানে ফুলগাছ লাগানো, গাছে গানেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ।
অমলপ্রভা দাসের পড়াশুনা:
ডিব্রুগড় থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে তিনি গুয়াহাটিতে চলে আসেন। তার ইচ্ছা ছিল কটন মহাবিদ্যালয়ে আই. এস. সি. পড়া। সেই সময় কটন মহাবিদ্যালয়ে কিন্তু সহ-শিক্ষার কোনো প্রচলন ছিল না। কটন মহাবিদ্যালয়ে কেবল ছেলেরাই পড়তে পারত। মেয়ে হওয়ার অজুহাতে অমলপ্রভাকে কটন মহাবিদ্যালয়ে পড়তে দেওয়া না হলেও, তিনি কিন্তু কোনোভাবেই দমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। তিনি এবার কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন।
শিক্ষা জীবনে এরকম বহু বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি ব্যবহারিক রসায়ন বিদ্যায়
এম. এস. সি. পাশ করেন। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম এম. এস. সি. ডিগ্রিধারী অসমিয়া মহিলা ৷
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অমলপ্রভা দাসের ভূমিকা:
অমলপ্রভা খুব ছোটোবেলা থেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯২১ সালে গান্ধিজি দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করলে অসমেও “বিদেশী বস্তু বর্জন’ ‘স্বদেশী বস্তু গ্রহণ’ কর্মকাণ্ড শুরু হয়। অমলপ্রভাদের পরিবার এই কর্মকাণ্ডে সামিল ইয়ে পরম নিষ্ঠায় চরকায় সুতা কাটতে শুরু করেন। দশ বছরের অমলপ্রভাও সুতা, কাঁটা শুরু করেন চরকায় সুতা কাঁটার এই অভ্যাস তাঁর সারাজীবন ছিল যখনই অবসর পেতেন তখনই তিনি সুতা কাটতেন। এমনকি কলেজের ছাত্র জীবনেও তিনি সময় বের করে নিয়মিত সুতা কাটতেন।
অমলপ্রভা দাস ছিলেন দৃঢ় চেতা এবং স্পষ্টবাদী। লুকিয়ে -চুরিয়ে কোনো কাজ করতে তিনি ভালোবাসতেন না। কলকাতায় পড়ার সময় বিপ্লবীদলের কয়েকজন ছাত্রী তাঁকে বিপ্লবীদলে যোগদান করতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তিনি বিপ্লবীদলে যোগদান করে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেশের কাজ করার কর্মপছ্থাকে সমর্থন করেননি। বরং তিনি গান্ধিজির পদ্থাকেই উত্তমপন্থা বলে গ্রহণ করণে জীবনের গোধূলি লগ্ন পর্যন্ত তিনি গান্ধিজির আদশেই অটল ছিলেন।
গান্ধিজির আদর্শে গঠনমূলক কাজ:
শিক্ষার পর্ব সমাণু করে অমলপ্রভা গান্ধিজির আদর্শে গঠনমূলক কাজে ব্রতী হন। এই কাজে পিতা ড° হরিকৃষ্ণ দাস এবং মাতা হেমপ্রভা দাস তাঁকে উৎসাহিত করেন গুয়াহাটির শরণিয়া পাহাড়ে ড° হরিকৃষ্ণ দাসের এক টুকরো জমি ছিল। অমলপ্রভা দেশের যুবক-যুবতীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেখানে গড়ে তোলেন তেল উৎপাদনের জন্য ঘানি, কাগজ তৈরি, সাবান তৈরি, কাপড় বোনার তাত ইত্যাদি কুটির শিল্প। এই উদ্যোগগুলোই ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার প্রকল্পের প্রথম গুভ সূচনা। কাজ-কর্মের মাধ্যমে স্বাবলম্বনের ভিত্তি দৃঢ় হলেই দেশ স্বাধীন হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার স্বদেশী কর্মকাণ্ডের এই স্থানটিতেই বর্তমানের কস্তরবা আশ্রম অবস্থিত।
১৯৪১ সালে স্বরাজ আন্দোলনের ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ কার্যসূচি আরম্ভ হলে, তিনিও এই কর্মযজ্ঞে যোগদান করেন। সত্যাগ্রহী অমলপ্রভা দাসপ্রামেগ্রামে গিয়ে স্বরাজ আন্দোলনের কথা প্রচার করার সময়ে গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যের স্বরূপ নিজচোখে প্রত্যক্ষ করেন। দেশের এই দরিদ্র জনতাকে উদ্ধার করার আকাঙ্ক্ষায় তিনি তীর ব্যক্তিগত সুখসস্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু পরিত্যাগ করেন। অবিবাহিত থেকে দরিদ্র্যের দুঃখ মোচনে তিনি ব্রতী হন। আন্দেলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে এই সময় জেলেও যেতে হয়।
আচার্য বিনোবা ভাবের শ্রমদান, ভু-দান আন্দোলনের সহযোগী হয়ে তিনি সমগ্র
অসম ভ্রমণ করেছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তিনি কোনো সরকারি চাকরি গ্রহণ করেননি,
বরং দারিদ্র্যেরকবল থেকে দেশের জনসাধারণকে উদ্ধার করার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলেন।
দেশবাসীর অদম্য সংগ্রামের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিদেশী ইংরেজদের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫৫ সালে ভারত-সরকার তাঁকে সমাজহিতকর কাজ কর্মের জন্য ‘পদ্মবিভূষণ’-এ সম্মানিত করেন। কিন্তু তিনি সেই সম্মান গ্রহণ না-করে
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে লিখেছিলেন ‘আমি সামান্যভাবে যে-টুকু
দেশসেবা করতে পেরেছি, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। কিন্তু আমি এই সম্মান গ্রহণ করতে অসমর্থ, কারণ এ-টি আমার মনে অহংকার ভাব এনে দেবে৷ এরজন্য অনুগ্রহ করে আমারে মার্জনা করবেন।” এভাবে নিরহংকারী অমলপ্রভা দাস রাষ্ট্রীয় সন্মানও প্রত্যাখান করেছিলেন।
অমলপ্রভা দাসের পরিচয় :
জন্ম – ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর ৷
পিতা -ড° হরিকৃষ্ণ দাস ।
মাতা – হেমপ্রভা দাস
মৃত্যু – ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর
আরো ও পড়ুন