লোক সংস্কৃতি পুতুল নাচ, যাত্রা-গান, কীর্তন, চড়কের শিব-কালীর সং, বরাকের বৌ নাচ, ধামাইল সব কিছুই লোক-সংস্কৃতির অস্তর্গত। এক সময় বাংলায় মনসামঙ্গলের কাহিনিকে নিয়ে পালা-গান, নাচ, অভিনয় ইত্যাদির পরম্পরা প্রচলিত ছিল।
শ্রাবণ মাস শুরু হতেই পাড়ার দিদা আর ঠাম্মারা রোজ কালীবাড়ির বারান্দায় একটা মোটা বই থেকে সুর করে কী যেন পড়েন। খুব ছোটোবেলা থেকেই এটা লক্ষ করেছে বুবাই। ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তরে বলেছেন, ওটা ‘মনসামঙ্গল’ পাঠ। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজার আগে এক মাস ধরে মন্দিরে বা বাড়িতে এই ‘মনসামঙল’পাঠ করতে হয়। বাবার কাছে এ সম্বন্ধে আরও জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বললেন “মনসাপুথি” পাঠ বাংলার এক পুরোনো এঁতিহ্য। মনসামঙ্গলের দেবী মনসা, চাদ সদাগর, বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। এই পরস্পরার বয়স কম করেও পাঁচ-ছশো বছর’ ।
বুবাই এই সম্বন্ধে কৌতুহলী হয়ে উঠল। গ্রন্থাগার থেকে একটি বই খুঁজে বের করে
সে জানতে পারল- যে বহু বছর ধরে সমাজে এধরনের ব্রত, পুথি-পাঠ, গল্প-কাহিনি, নাচ-গান, অভিনয় প্রচলিত থাকলে তাকে লোক-সংস্কৃতির অঙ্গ বলে ধরা হয়। পুতুল নাচ, যাত্রা-গান, কীর্তন, চড়কের শিব-কালীর সং, বরাকের বৌ নাচ, ধামাইল সব কিছুই লোক-সংস্কৃতির অস্তর্গত। এক সময় বাংলায় মনসামঙ্গলের কাহিনিকে নিয়ে পালা-গান, নাচ, অভিনয় ইত্যাদির পরম্পরা প্রচলিত ছিল।
লোক সংস্কৃতি – অসমে মনসা মনসামঙ্গলের কাহিনিঃ
‘মনসামঙ্গলে’র কাহিনি নিয়ে অসমের সংস্কৃতিতেও গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ পরস্পরা। সুকনানি অর্থাৎ ‘সুকবি বল্লভ’ নারায়ণদেবের ‘পদ্মাপুরাণে’র আখ্যান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ‘ওজা-পালি’ লোক-নাট্যের এক বিশেষ ধারা। এই ধারাটিকে সুকনারি ওজা-পালি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত অসমিয়া সংস্কৃতিতে নৃত্য-সীত-বাদ্য সম্বলিত ওজা-পালি লোক-নাট্যের ধারাটি কয়েকশো বছর ধরে বিশেষ জনপ্রিয়। ‘ওজা’ হলেন অনুষ্ঠানটির মুখ্য পরিচালক। তীর সঙ্গে থাকেন একজন মুখ্য সহায়ক এবং কয়েকজন ‘অনুচর। মুখ্য সহায়ককে বলা হয় ‘দাইনা-পালি’এবং অন্যদের ‘পালি’। অনুষ্ঠানে ‘ওজা’ আখ্যানের মূল পদ পরিবেশন করেন এবং ‘পালি’-রা সেই পদের পুনরাবৃত্তি করেন। বিভিন্ন রাগ ও তালের গীত পরিবেশনের সময় ওজা নানা ধরনের অঙ্গ-সঞ্চালন করেন। দাইনা-পালিও নেচে-গেয়ে অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধি করেন। পালিরাও তাল-মান রক্ষা করে শরীর দুলিয়ে পদ সঞ্চালন করেন। ওজা এবং দাইনা পালির কথোপকথনের মাধ্যমে এক সরস পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং আখ্যানের মূল বিষয়বস্তু দর্শক-শ্রোতা সহজেই বুঝে নিতে সুকনান্নি ওজা-পালিতে মনসা, দুর্গা, কালী প্রমুখ দেবীর মাহাত্ম্য প্রকাশক পদ করা হয়। মনসা পূজার সময় তাঁরা পল্মপুরাণ, বেহুলা-লখিন্দরের আখ্যান
করেন।
অসমের সুকনান্নি ওজা-পালির মতো বঙ্গদেশে ‘মনসার ভাসান’ জনপ্রিয় ছিল৷ এই
‘ভাসান’ গানের গায়কেরা বেহুলা-লখিন্দির কাহিনির বিভিন্ন চরিত্রের ভূমিকায় উপযুক্ত বেশভষার সজ্জিত হয়ে আসরে অবতীর্ণ হতেন এবং নেচে-গেয়ে আখ্যান পরিবেশন করতেন। খোল ও মন্দিরা সহযোগে বাদ্যযন্ত্রীরা তাদের সহযোগিতা করতেন।
মনসামঙ্গলের মতো বাংলায় মঙ্গলচণ্ডীর পূজাতে নৃত্য-সশীতাদ্যের প্রচলন ছিল । অনুষ্ঠানে যিনি মূল সংগীত পরিবেশন করতেন, তাঁকে ‘মূলগায়েন’ বলা হত যাঁরা মূলগায়েনকে সংগীতে সহযোগিতা করতেন বা মূল-গায়েনের পুনরাবৃত্তি করতেন তাঁদের ‘দোহার’ বলা হত। মন্দিরা, খোল, তানপুরা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যারা সহযোগিতা করতেন, তাঁদের বলা হত ‘বায়েন’। মূলগায়েন এবং দোহারেরা মন্দিরা নিয়ে তালে তালে নেচে নেচে গান পরিবেশন করতেন।
পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় শিবের মহাত্ম্যসূচক ‘গম্ভীরা’ উৎসব প্রচলিত গম্ভীরা-মণ্ডপে শিবদূর্গা, রাম-লক্ষ্মণ, ভূত-প্রেত, হনুমান, বুড়া-বুড়ি নৃত্য ইত্যাদি আমোদজনক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এই নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠানে নানা ধরনের মুখা বা মুখোশ ব্যবহার করা হয়। ‘হনুমান-মুখা’ গম্ভীরা উৎসবের আমোদ-আনন্দে এক বিশেষ মাত্রা যুক্ত করে।
বাংলায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক ‘ঝুমুর’ ও ‘ধামালি’ অনুষ্ঠানে নৃত্য-সীতবাদ্যের এক পরম্পরা প্রচলিত ছিল। এ-টিও লোক-সংস্কৃতির অঙ্গ। কৃষ্ণকথা নিয়ে বাংলায় ‘কালীয় দমন” অভিনয় রীতির যে এঁতিহ্য প্রচলিত ছিল, তা লোক-নাট্যের অন্তর্গত।
বঙ্গ-সংস্কৃতিতে রামায়ণ-মহাভারত এবং মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের কাহিনি আগে নীচালি-ছন্দে পরিবেশন করা হত। এই পাঁচালির দুটি অঙ্গ গান এবং ছড়া বা পয়ার। ছড়ার বর্ণনাময় অংশটুকু গায়ক খুব তাড়াতাড়ি আবৃত্তি করতেন। মূল গায়কের ডান হাতে থাকত মন্দিরা, বাঁ হাতে চামর এবং পায়ে নূপুর। অনুষ্ঠানে তাকে সহযোগিতা করতেন দোহার এবং মৃদঙ্গ বাদকেরা। এই পাঁচালির অনুষ্ঠান থেকেই বাংলায় যাত্রাগানের উদ্ভব হয়েছিল।
Read more