রাভা দিবস, কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার জীবনী Rabha Divas. Biography of Kala Guru Bishnuprasad Rabha
কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা |
১৯৪০ সালের কথা । কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান। অসম থেকে আগত এক শিল্পী নৃত্য পরিবেশন করে চলেছেন । তার তাণ্ডব নৃত্যের তালে তালে কেঁপে উঠল পুরো মঞ্চ। অনুষ্ঠানের নানা পর্যায়ে এই শিল্পী প্রদর্শন করলেন আরো কত ধরনের নৃত্য। ওজাপালি নৃত্য, কালীয়দমন নৃত্য । দর্শকরা অভিভূত ও বিস্মিত। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাকে আমরা সবাই জানি শিক্ষককুলগুরু দার্শনিক ড° সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন । মুগ্ধ বিস্মিত তিনি। শিল্পীর নৃত্যের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন। সেই অনুষ্ঠানের সংগঠক ছিলেন প্রেমচান্দ। একই প্রশংসার স্রোত তার মুখেও।
অসমের সুসস্তান এই নৃত্যশিল্পীর নাম বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা। ১৯০৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারী পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে তার জন্ম | প্রাথমিক শিক্ষাও সেখানে। মেধাবী ছিলেন। তাই সুনাম ছিল তার। তেজপুর শহর থেকে মাধ্যমিকগরীক্ষা পাশ করেন।লাভ করেন ‘কুইন এক্সপ্রেস” পুরস্কার। তারপর যান কলকাতায় সেন্ট পল্স মিশনারি কলেজ থেকে আই এস সি পাশ করলেন।
এই পর্বে সারা ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আন্দোলনে তোলপাড়। রাভাও যোগ দিলেন তাতে নির্যাতন নেবে এলো। কলকাতা ছেড়ে কোচবিহার গিয়ে ভর্তি হতে হল। ভারতের তেরঙা পতাকা তুললেন। সে অপরাধে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। চলে গেলেন রংপুর। সেখানকার কারমাইকেল কলেজে বি.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানেও পুলিশ। নজর এড়াতে তাঁকে অনবরত পালিয়ে বেড়াতে হয়। পড়াশুনা বাধা পেল।
বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা বহুমুখী প্রতিভার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি একাধারে নৃত্যশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং বাদ্যশিল্পী ছিলেন। কলার অফুরন্ত কৌশলের বিচিত্র প্রদর্শনের ক্ষমতা ছিল তার মানুষের কাছে ‘কলা-গুরু’ বলে পরিচিত হয়ে গেলেন তিনি।
শৈশবেই শুরু হয়েছিল কলা-সাধনা। তখন মাত্র আট বছর বয়স তাঁর। ঢাকায় ছিলেন ওস্তাদ কালাচাঁদ। তারই কাছে বিষ্ণুপ্রসাদের নৃত্য ও অভিনয়ের তালিম হল শুরু । তারপর ক্রমে ক্রমে বঙ্গের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মোতি মিঞা, গহরজান বিবি। গীত-বাদ্য-নৃত্যের কত কিছু শিখলেন তাদের কাছে। রাশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যাঙ্গনা পাভলোভা এসেছেন কলকাতায় তার নৃত্যে মুগ্ধ বিষ্ণুপ্রসাদ। দেখা করলেন তার সাথে। অনুপ্রাণিত হলেন বিষ্ণুপ্রসাদ। নৃত্যমূর্তি নিয়েও গবেষণা করলেন তিনি।
বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রস্থল ছিল তেজপুরের বাণ থিয়েটার। সেখানে তিনি সংগীত ছাড়া অভিনয়ও করতেন। ছিলেন বহুভাষাবিদ। নানা জনজাতীয় ভাষা জানতেন। বড়ো, রাভা তো জানতেনই | অসমীয়া-বাংলা-নেপালিতে ছিলেন অনর্গল। ইংরেজী ও হিন্দীতেও দক্ষ ছিলেন। সব ভাষায় সঙ্গীত গেয়ে সমন্বয়-সেতু গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। শোনা যায় শান্তিনিকেতনে একবার যোলটি ভাষায় সংগীত পরিবেশন করলেন। দর্শক-শোতারা প্রশংসায় ভেঙ্গে পড়েছিল।
তিনি একজন সুনিপুণ চিত্রকরও ছিলেন৷ উল্লেখযোগ্য চিত্রও রয়েছে তার ভাণ্ডারে। শ্রীমন্ত শংকরদেবের চিত্রটা তো রীতিমত বিখ্যাত। তাছাড়া ‘বাঁহী’ পত্রিকার একটা প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাত সিঁড়ির সিংহাসনের ছবিটাও সর্বজনপ্রশংসিত।
বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা একজন বাদ্যশিল্পী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। বাজাতেন নানা
ধরনের বাদ্যযন্ত্র। হারমোনিয়াম, তবলা, এস্রাজ, অর্গান, বেহালা, সেতার বাজাতেন | অসমের বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র রয়েছে, যেমন- ঢোল, খোল, তাল, পেঁপা, টকা, কালি, টকারী। এদের নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়নও করেছিলেন তিনি।
অসম তথা ভারতের কলাকাশের এই অন্যতম নক্ষত্রটি চিরদিনের মতো ঝরে পড়ল ১৯৬৯
সালের ২০ জুন তারিখে । তার মৃত্যু-দিবস অসমে ‘বিষ্ণুরাভা দিবস’ (Rabha Divas) হিসেবে পালিত হয়।
(উৎস – বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা রচনা সম্ভার, দ্বিতীয়খণ্ড, প্রকাশক – রাভা রচনাবলি প্রকাশন সংঘ, তেজপুর)।