বীরাঙ্গনা মুলাগাভরু : কপিলি গঙ্গা যুদ্ধ বা কলিয়াবরের যুদ্ধ
ইতিহাস প্রসিদ্ধ অসমের মানুষ সাহস এবং বীরত্বে অতুলনীয়। এ রাজ্যের নারীরাও পুরুষের সমকক্ষ৷ প্রয়োজন হলে তাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করতেও পারেন। অসমের মাটিতে অনেক মহীয়সী বীরাঙ্গনা জন্মগ্রহণ করেছেন,তাদের বীরত্বের কাহিনি অসমভুমিকে মহীয়ান ও পবিত্র করেছে। সেই বীরাঙ্গনা নারীদের মধ্যে মুলাগাভরু এ অন্যতম।
একসময়ে অসমে আহোমরা রাজত্ব করতেন। তাঁদের রাজত্বকালে পশ্চিমের মুসলমানরা বহুবার অসম আক্রমণ করেছিল। আহোম রাজা এ, স্বর্গদেউ চুহুংমুঙ বা স্বর্গ নারায়ণের রাজত্বকালেই মুসলমানরা প্রথম | অসম আক্রমণ করে। তুর্বক ছিল মুসলমানদের প্রধান সেনাপতি । তিনি পথে কোনো বাধা না পেয়ে কলিয়াবর পর্যন্ত চলে এলেন স্বর্গদেউ আসন্ন বিপদের আভাস পেলেন। কলিয়াবরে তুর্বকের সঙ্গে আহোম সেনার তুমুল যুদ্ধ হল। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই যুদ্ধ ‘কলিয়াবরের যুদ্ধ’ বা ‘কপিলিগঙ্গা যুদ্ধ’ নামে খ্যাত । ইতিমধ্যে মন্ত্রী বুড়া-গৌহাই সহ আটজন প্রধান প্রধান আহোম যোদ্ধা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। স্বর্গদেউ খুব চিন্তায় পড়লেন।
এরপর স্বগদেউ অন্য একজন মন্ত্রী ফ্রাচেংমুং বরগোহাইকে প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত করে তুর্বককে
প্রতিহত করার আদেশ দিলেন। মুলাগাভরু এই বরগোঁহাইয়েরই পত্নী। স্বর্গদেউয়েই আদেশ মেনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ফ্রাচেংমুং বরগোহাই পত্নী মুলাগাভরুর কাছে ‘কবচ কাপড়’ চাইলেন। হঠাৎ বরগোঁহাইদেব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় মুলাগাভরু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। নিজস্ব সমস্যার জন্য মুলাগাভরু রাতের মধ্যে ‘কবচ কাপড়’ তৈরি করে দিতে পারলেন না। সেজন্য তিনি বরগোঁহাইকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিলেন। বরগৌহাই বললেন- “আমি আর দেরি করতে পারছি না। যুদ্ধের জন্য সব সরঞ্জাম তৈরি হয়েছে। আমি তুর্বককে ‘কবচ কাপড়’ ছাড়াই বিতাড়িত করতে পারব”। মুলাগাভরু নানাভাবে বুঝিয়ে তিনি যুদ্ধে যাত্রা করলেন। দু-পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো। তুর্বকের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও বরগৌহাই জিততে পারলেন না। অবশেষে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন। বরগোঁহাই- এর মৃত্যুর খবর আহোম রাজধানী গড়গাঁও- এ ছড়িয়ে পড়ল। মুলাগাভরু শোকে ভেঙে পড়লেন, তিনি ভাবলেন ‘রাতের মধ্যে কবচ কাপড় বুনে না দেওয়ার জন্যই আমার স্বামীর এ দশা হল।
স্বামীর মৃত্যুতে বিচলিত না হয়ে পতির হত্যাকারী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন। স্বর্গদেবের অনুমতি নিয়ে তিনি হাতে হেংদাঙ নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে রওনা দিলেন। মুলাগাভরুর সাহস দেখে আরও অনেক আহোম রমণী তাঁকে সঙ্গ দিতে এগিয়ে এলেন। নারী বাহিনীর মনোবল এবং বীরত্ব দেখে আহোম সেনার মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল।
এই বীরাঙ্গনারা মুলাগাভরুর নেতৃত্বে মহাপরাক্রমে যুদ্ধ করে বহু মোগল সৈন্যকে বধ করলেন। মোগল সৈন্য মুলাগাভরুন সাহস এরং বীরত্ব দলে বিস্মিত হল। তুর্বকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ায় দু-দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হল। অবশেষে তুর্ববের অন্তরের আঘাতে মুলাগাভরু হাতির পিঠ থেকে ভূপতিত হলেন। এরপর কনচেং বরপাত্র গোঁহাই নামে অপর এক মন্ত্রীর নেতৃত্বে আহোম সেনা পাঠান সৈন্যকে পরাস্ত করে করতোয়া নদী পর্যন্ত বিতাড়িত করল। মুলাগাভরুর মৃত্যু হল সত্য, কিন্তু দেশের জন্য, স্বামীর জন্য তিনি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে প্রাণ দিলেন। তাঁর আদর্শ আজও চিরস্মরণীয়। আমরা এমন অনেক নারীর কথাই জানি, যারা নর জন্য কাজ করে গেছেন- তাঁদের মধ্যে ঝান্সির রানি লক্ষ্মীবাই, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, সুলতানা রেজিয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।
Also Read - নেপাল আর গোপাল