Bangla Golpo Bengali Story বাংলা গল্প ও কাহিনী ‘দুঃখী মাছের গল্প’
দুঃখী মাছের গল্প
খুব ছোটবেলার কথা তোমাদের মনে আছে? ধরো, মজার কোনও মানুষের কথা কিংবা আনন্দের কোনও ঘটনা? একজন মজার মানুষের কথা এখনও আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। লোকটা দিনের শেষে শ্রীরামপুরের গঙ্গাঘাটের কাছেই নৌকোয় শুতে আসতে! দুটো নৌকো পাশাপাশি বেঁধে একটায় মাথা আরেকটায় পা দিয়ে ঘুমোত। যতক্ষণ জেগে থাকত ততক্ষণই যে-ই তার দিকে তাকাক না কেন, সকলের দিকেই সে অদ্ভুত একটা হাসি নিয়ে চেয়ে থাকবে। ভারি মজার মানুষ না? আমি লোকটাকে দেখতাম আর ভাবতাম—— নদীর ঢেউয়ে নৌকো দুটোর বাঁধন আলগা হয়ে গিয়ে লোকটা ঘুমের ঘোরে জলে পড়ে যাবে না তো!
তবে শ্রীরামপুরে আমার ছোটবেলার একটা বড় মজা ছিল-পৌষসংক্রান্তির দিনে সকাল
থেকে বড়দের ঘুড়ি ওড়ানো দেখা। সারা আকাশ পঙ্গপালের মতো ঘুড়িতে ঘুড়িতে যেন ঢাকাপড়ে যেত।
সবচেয়ে বড় আনন্দের ঘটনা ঘটত বিজয়া দশমীর দিনে। আনন্দের, আবার দুঃখেরও। বিকেল থেকে আমি দাদুর সঙ্গে কালীবাবুর ঘাটে চাদর বিছিয়ে বসে যেতাম, সন্ধে হলেই শুরু হবে ঠাকুর-ভাসান জোড়বাঁধা নৌকোয় দুর্গা ঠাকুরকে মাঝগঙ্গার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে আস্তে করে জলে ফেলে দেওয়া হত। দেখতে দেখতে আমার দুচোখ জলে ভরে উঠত।
ছেলেবেলার একটা দিনের কথা আমি কোনও দিনও ভুলব না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঘাটে
ইলিশের নৌকো আসার অপেক্ষায় আমি দাদুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি, ইলিশের নৌকো দেখে দাদু আমার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। জলের ওপর ভাসমান নৌকোয় প্রায় ঝুকে পড়ে মনের মতো ইলিশ পছন্দ করতেই তিনি ব্যস্ত।
গঙ্গার এপারে শ্রীরামপুর, ওপারে ব্যারাকপুর। আমি ওপারে ব্যারাকপুরের মানুষজন দেখছি। এত দূর থেকে বড়দেরও খুব ছোট্ট দেখায়। সবাইকেই মনে হয় ছোট। খুব ছোটবেলায় আমি দাদুর মুখে গালিভারের গল্প শুনে ভাবতাম ব্যারাকপুরই নিশ্চয় লিলিপুটদের দেশ। দাদুর কাছেই শুনেছি, তাঁদের ছোটবেলায় শ্রীরামপুরের গঙ্গতীরে সারি সারি বটগাছের ছায়ায় আর নয়নতারা আর সন্ধ্যামালতীর ঝোপে একেবারে রূপকথার দেশ হয়ে যেত। নদীর জল- হাসানো জোছনায় রঙিন ফুলের বোপে পরীও নাকি নামতে দেখেছে অনেকে।
দাদু দেখলাম নকুল-জেলের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে কথা বলছেন। নকুল-জেলের ছেলেকে দাদু অঙ্ক শেখান, এজন্য তিনি কোনও পয়সা নেন না, নকুলও তাই দাদুকে খাতির করে, বেশ চওড়া পেট দেখে ভালো ইলিশ বেছে নিতে দেয়। দাদু আমাকে সিঁড়ির মাথায় দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, আমি কখন যে অন্যমনস্কভাবে সিঁড়ির একেবারে নীচে নেমে এসেছি জানি না, হঠাৎ দেখলাম, নৌকোর মধ্যে থেকে একটা মাছ আমার চোখে চোখ রেখে অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে।
দেখতে দেখতে আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কী মাছ এটা? ইলিশ তো নয়ই, এরকম মাছ আমি কখনও দেখিনি। মুখটা হালকা নীল, পিঠের দিকটা কামলারঙের, তার নীচেই বেগুনী, পেট পেঙ্গুইনের পেটের মতো সাদা, ঠিক যেন সিল্কের। সবচেয়ে অদ্ভুত মাছটার পাখনা। মনে হয় গাঢ় সবুজ শ্যাওলার টুকরো। মাছটা আকারেও মাঝারি মাপের ইলিশের চেয়ে বেশ কিছুটা ছোট। এবার মাছটার চোখে চোখ পড়তেই আমার বুকের মধ্যে কেউ যেন ঢাক বাজাল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম চোখের ভাষায় মাছটা আমাকে বলছে, “আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।”
মুখে কোনও শব্দ না করে শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে কথা বলা নতুন কিছু নয়, অনেককেই এরকম কখনও কখনও বলতে হয়। শুধু মানুষই নয়, বাড়ির পোষা কুকুর, মেঘলা মাঠের একলা গোরু, এমনকী দুপুর রোদের কাঠবিড়ালিকেও আমি শুধু চোখের ভাষায় কথা বলতে দেখেছি। কোনও মাছকে এই প্রথম দেখলাম। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের, দাদুর কাছে শুনেছি মাছের চোখ জামার বোতামের মতো, একেবারে অসাড়, তাতে কোনও ভাব ফোটে না। দাদুও বোধহয় আমার চোখের দৃষ্টিতে কিছু দেখেছিলেন, সিঁড়ির এতটা নীচে নেমে আসায় বকতে গিয়েও হেসে ফেলে বললেন, “তুই-ও একটা ইলিশ পছন্দ করলি নাকি? বল, কোনটা চাস?” দাদুর দুহাতে বড় বড় দুটো ইলিশ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে নিজেও ভিজছেন, ইলিশদুটোকেও ভেজাচ্ছেন। আমি আঙুল দিয়ে ওই অদ্ভুত মাছটাকে দেখিয়ে দিলাম।
“এ তো রঙিন মাছ। সাগর থেকে ভেসে এসেছে। পূষবি না কি?” বলে দাদু নকুলকেও মাছটা দেখালেন। নকুল মাছটা তুলে ধরতেই মাছটা ছট্-ফট্ করতেলাগল। দাদু দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তোর একটা মাটির হাঁড়িতে জলের মধ্যে মাছটাকে ছেড়ে দে। হাঁড়িটা সাবধানে নিয়ো দাদু” শেষে কথাটা বললেন আমাকে। তারপর ছাতার তলায় এসে উপহার দেবার আনন্দে বলে চললেন, “আজই তোমায় মাছপোষার কাঁচের বাক্স একটা এনে দেব। তাতে জলের মধ্যে নুড়িপাথর, ঝামা, সমুদ্রের ঝিনুক দিয়ে মাছের বাসা বানাতে হবে। মাছটাকে কী খেতে দেবে ভাবতে আরম্ভ করো।”
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে অনেক রাতে আমি কাছে এসে মাছটার চোখে চোখ রেখে দাঁড়াই। মৃদু আলোয় মাছটা এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে যে, আমি যেন ওর অনেক কথাই বুঝতে পারছি। মনে হয় ও যেন বলছে- বহুদূরের সমুদ্রে ওর দেশ। মা-বাবা,ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধবের মেহ-ভালোবাসায় ভরা সে ছিল এক আনন্দের দেশ। তারপর দুঃখে-দুর্দশায়, যুদ্ধে-হিংসায় ওর সেই সুন্দর দেশ এখন নরক। দয়ামায়াহীন, লোভ-লালসায় পাগল লোকজনে ভরে গেছে। এমন দেশে একে একে মা বাবা ভাই বোন বন্ধুবান্ধব সবাই কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা যাবার পর এই তিন বছরে কত সাগর-উপসাগর নদ-নদী পার হয়ে নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে এখানকার জেলের জালে ধরা পড়েছে। দূরে থানায় রাতের ঘন্টা শুনে আমার মনোযোগ ভেঙে যায়। ঘন্টার রেশ মিলিয়ে যাবার পর মাছটা আবার তার গল্প শুরু করে-
“তিন বছর ধরে ক্ত মানুষের চোখে একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা, একটু মায়া, একটু মমতা খুঁজলাম। দুচোখ ভরা শুধু লোভ আর নিষ্টুরতা। তার মধ্যে তোমার চোখে চোখ পড়তেই মন আশার আনন্দে ভরে গেল। এখানে আমি মনের মতো আশ্রয় পাবই।
হটাৎ খটাস করে বারান্দার লাইট জ্বলে উঠল, আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। আমার কি তন্দ্রা এসে গিয়েছিল? দাদু সুইচে হাত রেখেই হাঁক পাড়লেন, “এখনও জেগে বসে আছিস! নিজে ঘুমোলি না, মাছটাকেও ঘুমোতে দিলি না।”
মাছ আমার চোখে চোখ রেখে জলের মধ্যে পাখনা স্থির করে ভেসে আছে। মাছ কি কখনও ঘুমোয়?
দাদু আবার ঘুমিয়ে পড়লে আমি পা টিপে টিপে মাছটার কাছে ফিরে এলাম। তার চোখ বোধহয় আমাকেই খুঁজছিল, বলল, “বদ্ধজলে বড় কষ্ট”।
ভোরের আলো একটুখানি ফুটতেই আমি মাছটাকে তার কাঁচের বাসা থেকে বের করে নকুল- জেলের মাটির হাঁড়িতে করে সোজা বৈদ্যবাটি নিয়ে গিয়ে আমার ছোটমাসির বাড়ির পুকুরে ছেড়ে দিলাম।
মাছটা জলে নেমেও সাঁতার কাটল না। একই জায়গায় ভেসে রইল। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি মরে গেলে তুমি এই পুকুরপাড়ের মাটিতে আমাকে পুঁতে দিও। আমি গাছ হয়ে বেঁচে উঠব। সেই গাছে ঠিক আমারই রঙের ফুল ফুটবে। আমার গায়ের মতো কমলা, তার নীচে বেগুনি, তারপর সাদা আর সবুজ রঙের সেই ফুলের গন্ধ হাওয়ায় ভেসে যতদুর ছড়িয়ে যাবে ততদূর পর্যন্ত কেউ কাউকে আর হিংসা, ঘৃণা আর ভয় করবে না। সবাই সবাইকে ভালোবাসবে ।”
“কীরে, এত বেলা অব্দি ঘুমোচ্ছিস, শরীর খারাপ হয়নি তো? মাছটাও তো দেখছি মরে গেছে।” —– দাদুর কথায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। বৈদ্যবাটি তবে স্বপ্নে দেখলাম!
দৌড়ে মাছের বাসার সামনে এসে দেখি মাছটা চিৎ হয়ে ভেসে আছে। সাদা সিক্কের মতো তার বুকে-পেটে কোনও স্পন্দন নেই।
চোখের জল মুছে আমি দাদুকে বললাম, “আমি ছোট মাসির বাড়ি যাব।”
“কেন রে, হঠাৎ?”
“এই মাছটাকে ছোটমাসির বাড়ির পুকুরপাড়ে পুঁতে দেব।”
দাদু কপাল কুঁচকে বললেন, “মাছ আবার কেউ পুঁতে দেয়? কী ব্যাপার রে?”
আমি সে কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, “আমি বৈদ্যবাটি যাব।”
আমি জানি, দাদু আমাকে ‘না’ বলতে পারবেন না। আমার বাবা কারগিল যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি বলে দাদু কোনও কাজেই ‘না’ বলেন না।
*****